অনলাইন ক্লাস
• অভিষেক ঘোষ
***
অখিলেশ বাবু স্বভাবে বেজায় গম্ভীর । তাই তাঁর কর্মস্থল, বেসরকারী স্কুলটিতে সহকর্মী থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রীরা -- সকলেই একটু সম্ভ্রমজনক দূরত্ব বজায় রাখে । বলাই বাহুল্য ভক্তি কম করে, ভয় পায় বেশি । ছেলেমেয়েরা কোনো প্রশ্ন পেটে এলেও, তাঁর সামনে মুখে আনতে পারে না । বলা যায় না, হয়তো রেগে গেলে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে নেবেন । আর যদি বা কেউ কোনো কারণে তাঁর ক্লাসে কথা বলে ফেলেছে তো তার নিস্তার নেই । তাঁর মুখ থেকে একে একে নির্গত হতে থাকে, রামায়ণ-মহাভারতে উল্লিখিত সেই সব অস্ত্র, যা ছেলেমেয়েদের বুক ভেদ করে অনায়াসে চোখে জল এনে দিতে সক্ষম । স্টাফ রুমে অনেকেই মুখে না বললেও, মনে মনে খুবই অসন্তুষ্ট হন । অথচ 'ভাবমূর্তি' জিনিসটাই এমন যে, তা একবার তৈরি হয়ে গেলে বাকিসব আপনা হতেই হয়ে চলে । তাই নব-নিযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারাও এসেই টের পেয়ে যান আর তাঁকে এড়িয়েই চলেন ।
অখিলেশ বাবুর অবশ্য তাতে কিছু এসে যেত না কোনোদিনই । কারণ অন্যের চোখে দুশ্চিন্তা ও ভীতি দেখতে দেখতে তিনি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, এই তাঁর কাছে স্বাভাবিক বোধ হয় -- তিনি উপভোগই করেন । তাঁর ইদানিং কেমন ধারণা হয়েছে, ছোটখাটো সব ব্যাপারেই তিনিই একমাত্র জ্ঞান দান করতে পারেন । কিন্তু এই হিসেবটা গোলমাল হয়ে গেল করোনা-পীড়িত বিশ্বে, স্কুলের কড়া নির্দেশে চালু হওয়া অনলাইন ক্লাসের প্রথম দিনেই । পারদর্শী ভাগ্নেকে ধরে অনেক কষ্টে মোবাইলে গুগল মিট অ্যাপ ইনস্টল করেছেন, কাজেও লাগাতে শিখেছেন । কিন্তু হাড়ে হাড়ে বুঝছেন, এ বড়ো ঝামেলার ।
অবশেষে নিজেদের মধ্যে এক-হপ্তা-ব্যাপী ট্রায়ালের পর তাঁর অনলাইন ক্লাস শুরু হল । মনে মনে ভেবেই রেখেছেন, শুরুতেই ধমক টমক দিয়ে ছেলে-মেয়েগুলোর ওপর এমন জাঁকিয়ে বসবেন, যাতে পরে আর টুঁ শব্দটি না করতে পারে কেউ... ।
কিন্তু ক্লাস শুরু হওয়ার মিনিট পাঁচেক পরেই প্রমাদ গুনলেন । কারণ তিনি দেখলেন, তাঁর চাকুরি জীবনে এই প্রথমবার... হ্যাঁ অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এই প্রথম নিজেদের ভিডিও অন করে রেখেও ছাত্রছাত্রীরা কেউ তাঁর কথা শুনছে না । রেগে তিনি অল্পেই যান, এক্ষেত্রেও তাই হল । পেল্লায় হাঁক ছেড়ে এমন বেদম চেঁচাতে শুরু করলেন আর ধমক-চমক দিতে লাগলেন যে স্বয়ং ইন্দ্রদেব-ও বোধকরি তাঁর বজ্র নিয়ে মেঘের মোটা থাম খুঁজে আত্মগোপন করলেন । এদিকে বাড়ির লোকজন ছুটে এসেছে অখিলেশ বাবুর ব্যক্তিগত স্টাডি রুমে । স্ত্রীর চিন্তা হচ্ছে, প্রেসারটা হয়তো খুব বেড়ে গেছে, বাড়ির কাজের লোকটা নিশ্চিত হল, লোকটা বদ্ধ পাগলই বটে । কিন্তু অখিলেশ বাবু বিস্ময়ে হতবাক্ ! এত হম্বিতম্বিতেও কাজ হল না দেখে ! এমনকি কেউ তাঁর কথায় কর্ণপাতও করছে না । কেন এটা হচ্ছে ? তিনি তো ওদের সব কথা দিব্যি শুনতে পাচ্ছেন, তার মানে নেটওয়ার্কও স্ট্রং আছে । তাহলে ! প্রচন্ড রাগে তাঁর সত্যিই এবার শরীরটা কেমন করতে লাগলো । প্রথম দিনটায় কোনো গোলমাল হলে, সামাল দিতে ভাগ্নেটা কাছেই ছিল । চাউমিনের প্লেট অর্ধভুক্ত রেখে তাই শেষমেষ তাকেই ছুটে আসতে হয় । "কই মামা দেখি তো কী হয়েছে ?" স্ক্রীনে আঙুল ছোঁয়াতেই সে তার সহজ বুদ্ধিতে বুঝে যায়, মামা ভিডিও অফ এবং স্পীকার-এর জায়গাটা মিউট করে রেখেছেন - ফলে তাঁর অমন ব্যাঘ্র গর্জন একটিবারের জন্যও বালক-বালিকাদের কানে প্রবেশ করে নি । বেচারারা এতক্ষণ ক্রমাগত বলতে চেষ্টা করে গিয়েছে যে, "স্যার, আপনি নিজেকে আনমিউট করুন ।" অখিলেশ বাবু এতক্ষণে সবই বুঝলেন । কিন্তু রাগ-টা চট করে গিলে ফেললে নিজের কাছেই নিজেকে ছোটো হয়ে যেতে হয় । তাই এবারে প্রচন্ড এক চিৎকারে ভাগ্নে-সহ ঘরভর্তি সমস্ত প্রিয়জনেদের পিলে চমকিয়ে বলে ওঠেন, "গেএএএট আউউউউউট !"